আ,হ,জুবেদঃ ”কোথাও কেউ নেই” ৯০এর দশকে গোটা বাংলাদেশে যে নাটকটি সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মোটকথা, বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের পছন্দের শীর্ষে ছিল যে নাটকটির অবস্থান।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রদর্শিত এই টিভি ধারাবাহিক নাটকটি এতোটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে, ধারাবাহিকটির প্রতিটা পর্ব, দর্শকরা প্রবল আগ্রহ নিয়ে উপভোগ করতেন। ধারাবাহিকের অগ্রগতির সাথে সাথে দর্শকরা বাকের ভাইকে পছন্দ করে ফেলেন এবং বাকের পক্ষে জনমত গড়ে উঠে। একপর্যায়ে যখন বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠে, তখন দর্শকরা প্রতিবাদমুখর হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে; চলতে থাকে মিছিল, দেয়াল লিখন, সমাবেশ।
ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে লোকজন মিছিল করে স্লোগান দিতে থাকে।
“বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কেন, কুত্তাওয়ালী জবাব চাই”
“বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে”
এসকল খবর, সমসাময়িক পত্র-পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় বেশ গুরুত্বের সাথে। তখন স্বভাবতই মনে হয়েছিল, হয়তো লেখক, জনমতের ভিত্তিতে ধারাবাহিকের গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তা না করে ধারাবাহিকটিকে তার যথাবিহীত পরিণতি দেন, এবং বাকের ভাইয়ের পক্ষে দর্শকদের তুমুল আবেগ এবং সমর্থন সত্ত্বেও ধারাবাহিকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়।
৯০এর দশকের পর থেকে শুরু করে অদ্যাবধি যেসব নাটক তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে আমি নেতিবাচক কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছিনা। সত্যি কথা বলতে কি, এমন মন্তব্য করা আমার জন্য হবে অনেকটা অনাধিকার চর্চা। কারণ আমি নাটকের জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি নয়।
কিন্তু কেন এবং কী কারণে আজ প্রায় ৩দশক পরেও দর্শকদের মন জয় করতে বাংলাদেশী নাটক গুলো অনেকাংশে অক্ষম, এব্যাপারটি নিয়ে বেশ বড় একটি প্রশ্ন জনমনে থেকেই যাচ্ছে।
এদিকে প্রায় দেড় যুগ ধরে বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল গুলোতে প্রচারিত বিভিন্ন বাংলা-হিন্দি নাটকের জনপ্রিয়তা ক্রমশই বাড়ছে , অথচ বাংলাদেশের ৪ ডর্জন স্যাটেলাইট চ্যানেলে বিরামহীন বিভিন্ন নাটক প্রচারিত হলেও দর্শকরা স্বদেশী চ্যানেল গুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
বর্তমানে এমনই পরিস্থিতি সর্বত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, ঘরে বাহিরে, সর্বত্রে শুধু স্টার জলসা ও জি-বাংলার আগুন লাগাও নাটক-ফিল্ম নির্দ্বিধায় চলছে।
একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল স্টার জলসা ও জি- বাংলার নানান কার্যক্রমের চরম নেতিবাচক প্রভাব পরছে বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে।
বাস্তব চিত্রের একটি উদাহরণ!
বাহিরে হাজারো কর্মব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত স্বামী সবেমাত্র ঘরে ফিরেছেন, স্বভাবতই এবার স্ত্রী দৌড়ে ছুটে এসে জীবনসঙ্গী স্বামীর সেবায় শতভাগ সময় দেবেন।
কিন্তু এদিকে সেই দীর্ঘক্ষণ ধরে স্টার জলসার একটি ধারাবাহিক নাটক দেখায় ভীষণ ব্যস্ততম স্ত্রী ঘরে স্বামীর উপস্থিতি টের পেয়ে বলে উঠলেন অনেকটা অপার বাংলার সুরে, কই গো? তুমি এসছো বুঝি?
এই যে শুনো, বোয়া ‘খইরুন’ খাবার টেবিলে দিয়েছে, ওয়াশ রোমের কাজ সেরে খেয়ে নাও।
বেচারা স্বামী সহধর্মিণীর কথা শুনে প্রচণ্ড রাগান্বিত হলেও, বেশ মিষ্টি সুরে বলে উঠলেন, না গো তোমাকে এটুকুও বলতে হবেনা, তুমি বরং স্টার জলসার বৌদিদিদের প্রিয় ”আগুন লাগাও সংসারে” নাটক দেখতে থাকো।
ঘরে চলছে বিরামহীন স্টার জলসা, জি-বাংলা সহ ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলের আগুন লাগাও নাটক ও ফিল্ম, চতুর্দিকে ঝামেলাপূর্ণ পরিবেশে অনেকটা অসুস্থ্য হয়ে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা সেবা নিতে এসে দেখা যায় এখানেও সেই স্টার জলসা ও জি-বাংলার আগুন লাগাও নাটক চলছে।
ভারতীয় বাংলা স্যাটেলাইট চ্যানেল গুলোতে যেসব ধারাবাহিক নাটক গুলো বর্তমানে চলছে যথাক্রমে, প্রেম কাহিনী, মায়ার বাঁধন, কুন্দফুলের মালা, পঠল কুমার গানওয়ালা, কুসুমধুলা, কে আপন-কে পর, অগ্নিজ্বল, সপ্নউড়ান, মিলন তিথি ইত্যাদি।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সুধী সমাজের মধ্যে সঞ্চার হয়েছে চরম উদ্বেগ, এক্ষেত্রে সবার একটি’ই প্রশ্ন যে, উপরোক্ত নাটক গুলো থেকে কী শিক্ষা নিচ্ছে আমাদের আজ ও আগামীর প্রজন্ম তথা সর্বস্তরের মানুষ।
অন্যদিকে একাংশ দর্শকদের অভিযোগ, আমরা ৯০এর দশকে নির্মিতি ‘’ কোথাও কেউ নেই’’ নাটকের ন্যায় দর্শকদের পছন্দে শীর্ষে থাকা একটি সেরা নাটক কিংবা এর পরবর্তীতে নির্মিত রূপনগর নাটকের মতো একটি ভালো নাটক পাচ্ছিনা।
অনেকে মনে করেন, এখনো যদি ‘’কোথাও কেউ নেই’’ নাটকের ন্যায় তৈরি হয় ভালো মানের নাটক, তবে অবশ্য’ই দর্শক ফের দেখতে শুরু করবে বাংলাদেশী চ্যানেলের নাটক, ভুলে যাবে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেল এবং তাদের সংস্কৃতি।